শিয়ায় বাড়ছে ‘ওমিক্রন’ প্রাদুর্ভাব। ভারতে শনিবার (৪ ডিসেম্বর) আরেকজনের দেহে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ায়ও ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ এর নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এটি ঠেকাতে প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ওমিক্রন কতটা সংক্রামক ও প্রাণঘাতী সে সর্ম্পকে এখনও নিশ্চিত গবেষকরা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ওমিক্রন শনাক্তের ১০ দিনের মধ্যেই বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন এই ধরনটিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসটিতে আক্রান্তদের কারো মৃত্যুর খরব পাওয়া যায়নি বলে ডব্লিউএইচওর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, তারা সপ্তাহজুড়ে করোনার নতুন ধরন কতটা সংক্রমণশীল, কতটা গুরুতর অবস্থা তৈরি করে, কিভাবে চিকিৎসা করা যায় এবং ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওমিক্রনের মিউটেশনের উৎস, ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
ওমিক্রনে কেউ মারা গেছে এখন পর্যন্ত এমন খবর পাওয়া যায়নি দাবি করে ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা জানিয়েছে, তবে ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে; যার কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে পরবর্তী কয়েক মাসে ইউরোপে অর্ধেকের বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।
ডব্লিউএইচওর জরুরি সেবা পরিচালক মাইকেল রায়ান বলেন, ‘ওমিক্রনের বিষয়ে আমরা সব প্রশ্নের উত্তর পেতে যাচ্ছি যেগুলো প্রত্যেকের জানা প্রয়োজন।’
গত ২৪ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ধরন শনাক্তের ঘোষণা দেয়। এরপর খুব দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। ডব্লিউএইচও এর নাম দেয় ‘ওমিক্রন’ এবং এটির বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয় ‘বি.১.১.৫২৯’। ডব্লিউএইচও ওমিক্রনকে উদ্বেগজনক বা ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাথমিক গবেষণার রিপোর্ট বলছে, করোনার ‘ডেল্টা’ বা ‘বেটা’ ধরনের চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণ তিনগুণ বেশি।
রেডক্রসের প্রধান ফ্রান্সেসকা রোকা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী টিকা বৈষম্যের কারণে কত বড় বিপদ আসতে পারে, ওমিক্রন সংক্রমণ তার বড় প্রমাণ। তিনি জানান, বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, টিকাদানের হার যেখানে সবচেয়ে কম সেখানে এটি বেশি ছড়াচ্ছে।
আতঙ্কিত নয়, প্রস্তুত থাকুন
করোনার ওমিক্রন ধরন নিয়ে বিশ্বের আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুত থাকা উচিত বলে মন্তব্য করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার শীর্ষ বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন। তিনি শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) এক সম্মেলনে বলেন, এক বছর আগের তুলনায় পরিস্থিতি এখন পুরোপুরিই ভিন্ন।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে ও অঞ্চলে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদ সংস্থা বিবিসি।
ওমিক্রন শনাক্তের পর প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কিছু অংশকে এড়িয়ে যেতে পারে। এই বিশ্লেষণটি চূড়ান্ত নয় বলে ডব্লিউএইচওর বিশেষজ্ঞের অভিমত।
সৌম্য স্বামীনাথন দক্ষিণ আফ্রিকার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ওমিক্রনকে ‘অতি সংক্রামক’ অ্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ভ্যারিয়েন্টটি সম্ভবত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের অন্যসব ভ্যারিয়েন্টকে হটিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে; যদিও এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।’
বিশ্বজুড়ে এখন করোনায় আক্রান্তদের ৯৯ শতাংশের দেহেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মিলছে জানিয়ে স্বামীনাথন বলেন, ‘কতটা চিন্তিত হবো আমরা? আমাদের সতর্ক এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। আতঙ্কিত নয়, কেননা এক বছর আগের তুলনায় আমরা এখন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আছি।’
ওমিক্রনের জিন বিন্যাসে ঠান্ডার ভাইরাসের বৈশিষ্ট
গকেষকরা ধারণা করছেন, ওমিক্রন সম্ভবত সাধারণ ঠান্ডার জন্য দায়ী অন্য একটি ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানের অংশকে সঙ্গে নিয়ে অন্তত একবার নিজের জিন বিন্যাসের পরিবর্তন (মিউটেশন) ঘটিয়েছে। কোন দেহের আক্রান্ত কোষে দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণের ফলে এটা হতে পারে।
গবেষকদের ভাষ্য, ওমিক্রনের যে জেনেটিক বিন্যাস, তা করোনাভাইরাস নামে পরিচিতি সার্স-সিওভি-২-র আগের সংস্করণগুলোতে দেখা যায়নি। তবে এই বৈশিষ্ট্য অন্য অনেক ভাইরাসে দেখা যায়, যেসব ভাইরাসের কারণে সাধারণ ঠান্ডা জ্বর দেখা যায়।
সুনির্দিষ্ট এই জেনেটিক উপাদান নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ওমিক্রন সম্ভবত নিজেকে আরও বেশি মানুষের উপযোগী করে গড়ে তুলছে, যা তাকে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফাঁকি দিতে সাহায্য করছে বলে ক্যামব্রিজ ও ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক ডাটা অ্যানালেটিক্স ফার্মের ভেঙ্কি সৌনদরারাজনের নেতৃত্বে একদল গবেষকের দাবি।
বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) ওয়েবসাইট ওএসএফ প্রিপ্রিন্টসে প্রকাশিত হয় গবেষণাটি। গবেষকদের ধারণা, জিন বিন্যাসে সাধারণ ঠান্ডার ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য থাকার ফলেই হয়তো ওমিক্রন মৃদু উপসর্গ বা কোন কোন ক্ষেত্রে উপসর্গ ছাড়াই সহজে ছড়াতে পারছে।
অতীতে কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুস ও গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমের কোষ একইসঙ্গে সার্স-সিওভি-২ ও সাধারণ ঠান্ডার করোনাভাইরাসকে আশ্রয় দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে একই হোস্ট কোষে দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে এবং নতুনটির একাধিক কপি তৈরি করতে পারে, যেগুলোর জিন বিন্যাসে আগের দুই ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান থাকে।
সৌনদরারাজন জানিয়েছেন, ওমিক্রনের মতো একই জেনেটিক বিন্যাস ঠান্ডার জন্য দায়ী এইচসিওভি-২২৯ই নামে পরিচিত করোনাভাইরাস এবং এইডসের জন্য দায়ী হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসে (এইচআইভি) অনেকবারই দেখা যায়।
ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকায় এইচআইভির হার সবচেয়ে বেশি। এই এইচআইভি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। একইসঙ্গে সাধারণ ঠান্ডার ভাইরাস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
এশিয়ায় ছড়াচ্ছে ওমিক্রন
এশিয়ায় বাড়ছে ওমিক্রনের দাপট। ইতোমধ্যে ভারত, হংকং ও মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হয়েছে।
৩ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী খাইরি জামালুদ্দিন ঘোষণা দিয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে আসা এক বিদেশি ছাত্রীর দেহে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগের বলার পর তারা আগের পজেটিভ নমুনাগুলো পুনরায় পরীক্ষা করে।
মালয়েশিয়ার মন্ত্রী জানান, ১৯ বছর বয়সী ওমিক্রন আক্রান্ত ওই ব্যক্তিরে কোন উপসর্গ ছিল না এবং টিকা নেয়া। সিঙ্গাপুর হয়ে মালয়েশিয়া আসার পর তার করোনা শনাক্ত হয়। ১০ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার পর ২৯ নভেম্বর তিনি ছাড় পান।
ভারতে ওমিক্রনে আক্রান্ত তৃতীয় ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। শনিবার দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছে।
ভারতের গুজরাতের সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ওমিক্রনে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়া তৃতীয় ব্যক্তির বয়স ৭২ বছর। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং জিম্বাবুয়েতে কয়েক দশক ধরে বাস করেছেন। ২৮ নভেম্বর ওই ব্যক্তি ভারতে আসেন।