বেলারুশ থেকে পোল্যান্ড আসা কয়েকশ’ অভিবাসীর মধ্যে অনেকেই কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন৷ মধ্য আফ্রিকা থেকে এই পথে জার্মানি পৌঁছানো দুইজন অভিবাসী তুলে ধরেছেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা৷
একজন রিপাবলিক অব কঙ্গো থেকে, আরেকজন ক্যামেরুন থেকে৷ ভিন্ন দুই পথে যাত্রা করেও আলডো আর বার্টান্ডের গন্তব্য এখন মিলেছে এক জায়গায়, জার্মানির শহর আইজেনহুটেনস্টাডে৷ কিন্তু তাদের কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো অনেকটাই অভিন্ন৷
৩৫ বছরের বার্টান্ড জার্মানিতে আছেন গত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে৷ তার এক মাস আগে কঙ্গোর ব্রাজাভিলে থেকে শুরু হয় তার যাত্রা৷ ফ্লাইটে বেলারুশে পৌঁছানোর পর পরই শুরু হয় কষ্টকর অভিজ্ঞতা৷ গোটা মাস তিনি ও তার ২০ বছর বয়সি ভাতিজি কোনো কম্বল ছাড়াই তীব্র ঠান্ডায় জঙ্গলে ঘুমিয়েছেন৷ ‘‘রাস্তা থেকে সংগ্রহ করে পানি পান করেছি, যা পেয়েছি তাই খেয়েছি,’’ বলেন তিনি৷
সীমান্তে অভিবাসীরা পোল্যান্ডের সেনাদের বিভিন্ন রকমের নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন বার্টান্ড৷ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমি দশবার পোল্যান্ডে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছি আর ফিরে এসেছি৷ তারা আমাকে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দিয়েছে, পশুর মতো ব্যবহার করেছে৷ গালি দিয়ে বলেছে, নোংরা নিগ্রো, তুই কেন এখানে এসেছিস?’’
তবে এক পর্যায়ে বার্টান্ডের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়৷ তার ভাষায় ‘‘ইশ্বরের অনুগ্রহে’’ আরবের এক অভিবাসী দলের সঙ্গে দেখা হয় তার৷ তারাই তাকে জার্মানি পর্যন্ত আসতে সহায়তা করে৷ তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গলে ওদের সঙ্গে দেখা হয়৷ তাদের নিজেদের বাহন ছিল৷ জানি না কিভাবে সেটা পেয়েছে৷ কিন্তু আমরা জার্মান সীমান্ত পর্যন্ত গাড়িতে আসি৷’’
সারা রাত হেঁটেছি
বার্টান্ডের সঙ্গে এক ছাতার নীচে হুইলচেয়ারে বসা ৩২ বছর বয়সি আলডো৷ তার পায়ের সমস্যা জন্মগত৷ আগে প্রোসথেটিক পা ব্যবহার করে হাঁটাচলা করতেন৷ বলেন, ‘‘হুইলচেয়ার ব্যবহারে আমি কখনো অভ্যস্ত ছিলাম না৷ কিন্তু প্রোসথেটিক পা-টি অনেক পুরনো আর ছিঁড়ে গেছে৷ আইজেনহুটেনস্টাডে পৌঁছানোর পর এটা আমাকে পীড়া দিয়েছে৷ দুই পায়ে ঘা হয়ে গেছে এবং এখন আর পরতে পারছি না৷’’
আলডোর যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্যামেরুন থেকে৷ দেশ ছাড়ার আগেই অগ্রিম তাকে প্রায় তিন হাজার ইউরো খরচ করতে হয়েছে৷ কথা ছিল এর বিনিময়ে আলডোকে নিয়ে যাওয়া হবে জার্মানিতে৷ কিন্তু তাকে পৌঁছে দেয়া হয় বেলারুশের একটি বাড়িতে৷ পাঁচদিন সেখানে কাটানোর পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভিন্ন এক জায়গায়৷ ‘‘আমাদের বলা হলো এটা সীমান্ত এবং আমাদের শুধু পার হতে হবে৷ যেন পাশের দুয়ারেই৷ কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই বুঝতে পারলাম ঘটনা ভিন্ন৷ আমরা সারারাত এবং সকাল আটটা পর্যন্ত হাঁটলাম৷ তারপর বেলারুশ অংশের পুলিশের দেখা পাই এবং সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করি৷’’
তাদের দলটিকে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দেয় বেলারুশ পুলিশ৷ আলডো বলেন, ‘‘কিন্তু পোল্যান্ডে ঢুকার পর দলের সঙ্গে থাকা শিশুসহ এক দম্পতিকে সেখানকার পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷ তাদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তাতে আমরা পুলিশের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারানোয় লুকিয়ে থাকি৷’’
চিৎকার করে বলি, ‘আশ্রয়প্রার্থী’, তারা বলে, না
আলডো তার যাত্রার কাহিনী বলে চলেন৷ ‘‘আমি ছিলাম টোগো থেকে আসা একজনের সঙ্গে৷ পরেরদিন পর্যন্ত হাঁটতে থাকলাম আমরা এবং আরেক গ্রামে গিয়ে পৌঁছালাম৷ রাত আর সকাল ছিল ভয়ানক ঠান্ডার৷ আমরা একটা চার্চ খুঁজে পেলাম এবং কড়া নেড়ে সহায়তা চাইলাম৷ একজন নারী এলেন৷ আমরা তার কাছ থেকে খাদ্য, পানীয় আর ফোন বা চার্জার চাইলাম৷ কারণ, আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি৷ ইঙ্গিতে তিনি ‘না’ বললেন এবং চলে গেলেন৷ আমরা চিৎকার করে বললাম, ‘আশ্রয়াপ্রার্থী!’ তারা বলল, না৷’’
আলডো না বুঝলেও তার টোগোলিজ সঙ্গী বুঝতে পেরেছিলেন তারা কী বলেছেন৷ তিনি বলে চলেন, ‘‘তারা আমাদের অপমান করছিল৷ ‘নোংরা নিগ্রো’ হিসেবে অভিহিত করে, বলে তোমরা এখানে স্বাগত নও৷ তারপর টোগোলিজ আমাকে বলে তারা আমাদের আবার সীমান্তে নিয়ে যাবে৷ আমি প্রোসথেটিক পরে এরই মধ্যে পায়ে যথেষ্ট ব্যাথা পেয়েছি৷ এটা শুনে ধাক্কা খাই, এমনটা আমার প্রত্যাশিত ছিল না৷’’
এরপর তাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আলডো বলেন, ‘‘আমি গাড়ি থেকে বের হতে চাইনি৷ ‘আশ্রয়প্রার্থী, আশ্রয়প্রার্থী!’ এই বলে চিৎকার করছিলাম৷ আমাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হলো, যদি সেখান থেকে এক পা এগোই, তাহলে গুলি করা হবে৷’’
আবারও আলডো নিজেকে বেলারুশে আবিষ্কার করলেন৷ কেন ফিরে এলেন সেজন্য তাকে গ্রেপ্তার ও মারধর করলো বেলারুশের পুলিশ৷ তবে এক পর্যায়ে আলডো বোঝাতে সক্ষম হলেন যে তারা পোল্যান্ডেই ফিরে যেতে চান৷ এতে বেলারুশ কর্তৃপক্ষের সুর বদল হলো৷ রাতে পোল্যান্ড সীমান্তে তাদেরকে পৌঁছে দেয়ার আগ পর্যন্ত খাবার, পানি এবং ফোন চার্জের সুযোগও দিলো পুলিশ৷
আলডোর তিনদিন লেগেছে পোল্যান্ড সীমান্ত পেরুতে৷ অর্থের বিনিময়ে একজন তাকে বাকি পথ পাড়ি দিতে সহায়তা করে৷ সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছান৷ সীমান্তে নজরদারিতে নিয়োজিত পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে৷
উভয়ই চান জার্মানিতে স্থায়ী ও এখানকার সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে৷ আলডো চান ভাষা শিখে এবং পায়ের সমস্যা কাটিয়ে কোনো কাজে নিযুক্ত হতে৷
আরবি ও ফরাসি ভাষায় ২৩ নভেম্বর, ২০২১-এ আলডো ও বার্টান্ডের সাক্ষাৎকারটি নেন মাজদা বউয়াজ্জা। সূত্রঃ ইনফোমাইগ্রেন্টস।