চীনের বালু রফতানি বন্ধে যেভাবে বিপাকে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের উসকানির জবাবে তাইওয়ানের ওপর বাণিজ্যসহ নানামুখী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে চীন। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় তা হলো চীনের বালু রফতানি বন্ধের ঘোষণা। বালু রফতানি বন্ধের কারণে তাইওয়ানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এই বালু থেকেই বানানো হয় আইফোন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক বিভিন্ন গ্যাজেটে ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ।
সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ কী?
কম্পিউটার, মুঠোফোন এবং অন্য সব আধুনিক ইলেকট্রনিক পণ্যের মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে ট্রানজিস্টর চিপ ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সব ইলেকট্রনিক পণ্যেই এই চিপের ব্যবহার রয়েছে। আর চিপ বানানোর মূল উপাদানই হলো বালু। যারা চিপ ডিজাইন করে, তাদের বলা হয় ‘ফ্যাবলেস’ কোম্পানি। আর যারা চিপ বানায়, তাদের বলা হয় ‘ফাউন্ড্রি’।
ফাউন্ড্রি মডেলের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলো হলো ইন্টেল, স্যামসাং ও তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি টিএসএমসি। স্যামসাং ও ইন্টেল ডিজাইন থেকে শুরু করে উৎপাদন ও বিক্রি সবই করে। অন্যদিকে টিএসএমসি শুধু ফাউন্ড্রি অর্থাৎ চিপ বানিয়ে থাকে। তাই টিএসএমসির পরিধি বিশাল। অ্যাপল, এএমডি, এনভিডিয়ার মতো কোম্পানিগুলোর ডিজাইন করা চিপ তারা তৈরি করে দেয়।
সেমিকন্ডাক্টরের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বিশ্বের প্রতিদিনকার কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তির ব্যবহার অনস্বীকার্য। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন এমনকি রেফ্রিজারেটরে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার রয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য এ রকম অসংখ্য ডিভাইসের পাশাপাশি পাওয়ার গ্রিড আর সামরিক খাতেও রয়েছে এর বিশাল ব্যবহার।
করোনা মহামারি-পরবর্তী সময়ে সেমিকন্ডাক্টরের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। ঘরে বসে অফিস, মিটিং, ক্লাস করার প্রবণতা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেককেই স্মার্টফোনসহ নতুন নতুন ডিভাইস কিনতে হয়েছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই দরকার হয়েছে অসংখ্য সেমিকন্ডাক্টর চিপ। অটো ইন্ডাস্ট্রিতেও সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। গাড়িকে আরও অত্যাধুনিক করতে এর ভেতর স্মার্ট সিস্টেম সংযোজন করা হচ্ছে। এসব কাজের জন্যও সেমিকন্ডাক্টর প্রয়োজন।
যুদ্ধের হাতিয়ার চিপ
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের পর তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলতে এরই মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মূল উপাদান বালু রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের চিপ ইন্ডাস্ট্রি বিক্রির দিক থেকে বিশ্ববাজারের ৪৭ শতাংশ দখল করে রেখেছে। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদনের দিক থেকে এই সংখ্যাটি মাত্র ১২ শতাংশ।
অন্যদিকে, তাইওয়ানের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ তৈরি করে থাকে। এর ফলে ভোক্তা প্রযুক্তি, গাড়ি এবং বিমান চলাচলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যাদের রফতানির প্রায় ৪০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তাইওয়ানের চিপের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক নির্ভরশীলতা থাকায় এই চিপকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে চীন। তাই তাইওয়ানে বালু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি। এমনিতেই করোনা মহামারির প্রভাবের পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে চিপ ঘাটতিতে ভুগছিল মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থায় তাইওয়ানে চীনের বালু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞায় সেই ঘাটতিকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার শঙ্কা
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তেল, জ্বালানিসহ মুদ্রাস্ফীতিতে নাকাল বিশ্ব অর্থনীতি। চিপ উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে বিশ্বজুড়েই এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, তাইওয়ান বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, এশিয়ায় জাপান ও সৌদি আরব কিংবা জার্মানিসহ ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিলের মতো তাইওয়ানের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোতেও মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
এ ছাড়া আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য ও ওশেনিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও তাইওয়ানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।
টিএসএমসির আধিপত্য
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ চিপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি–টিএসএমসি। সবচেয়ে উন্নত চিপের বাজারের ৯০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ১০ ন্যানোমিটারের চেয়ে ছোট বা কাগজের শিটের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার গুণ পাতলা চিপগুলো আইফোন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটিং ডিভাইসগুলোর কেন্দ্রে বসানো হয়।
টিএসএমসি ছাড়া সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করতে পারে শুধু ইন্টেল ও স্যামসাং। কিন্তু তাদের প্রযুক্তি টিএসএমসির মতো এত উন্নত নয় এবং তারা দ্রুতগতিতে তা উদ্ভাবনও করতে পারছে না। চিপ ডিজাইন করার পরিবর্তে এগুলো তৈরির ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়েই আধিপত্য অর্জন করেছে টিএসএমসি।
বিশ্লেষকদের ধারণা, টিএসএমসি যেহেতু বিশ্বের বৃহত্তম চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান; তাই তাইওয়ানের বিশাল সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দখল নিতে তৎপর চীন। টিএসএমসির বোর্ড অব ডিরেক্টরসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের প্রবেশ কিংবা অন্য যেকোনোভাবে তারা কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের মূল উদ্দেশ্যই হলো সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দখল নিয়ে বিশ্বে আধিপত্য সৃষ্টি করা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে কোণঠাসা করা।