দেশসেরা ওপেনার ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল অশ্রুসজল চোখে গতকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ওয়ানডে সিরিজ চলাকালীন গতকাল নিজের ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।
আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে পুরোপুরি ফিট না হয়ে খেলতে নেমে বিসিবি
সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কড়া মন্তব্যের শিকার হন তামিম।
কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে করে অসন্তুষ্ট হন তামিম।
এ কারণেই বিশ্বকাপের আগে হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বলে চারদিকে গুঞ্জন চলছে।
তামিমের আকষ্মিক অবসরের ঘোষণায় অবাক হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তারাও।
বিসিবি চেষ্টা করেছে তামিমকে এ সিদ্ধান্ত থেকে নিবৃত্ত করতে।
কিন্তু তামিম সে অনুরোধে সাড়া দেননি।
হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্তে আবেগঘন বার্তা দিয়েছে জাতীয় দলের বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা।
তামিম ইকবালের অবসর ইস্যু নিয়ে গতকাল আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
তবে মন্তব্য জানানোর আগেই রাতে রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে সভা ডাকে বিসিবি।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, ‘সিরিজ চলাকালে অধিনায়ক চলে যাওয়াতো ইতিহাস।
এ ঘটনা ক্রিকেটের জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনে না। এ থেকে ভবিষ্যতে ক্রিকেটাররা কী শিখবে?
যাদের কারণে তামিম ইকবাল হঠাৎ করে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
অবসরের কারণ কী? এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য পেতে হলে ক্রিকেট বোর্ডের
কর্মকর্তাদের দিয়ে নয়, সাবেক ক্রিকেটার, সাংবাদিক ও পুলিশের লোক দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
ভবিষ্যতে আর কোনো অধিনায়ক যেন এমন করে অবসরের ঘোষণা না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা ক্রিকেটের জন্য কল্যাণকর নয়।’
দীর্ঘদিন ধরেই ফর্মে ছিলেন না তামিম।
চোট থাকা সত্ত্বেও গত পরশু আফগানিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন।
সেখানেও হয়েছেন ব্যর্থ। ২১ বলে করেন ১৩ রান।
পুরোপুরি ফিট না হয়ে খেলতে নামায় তামিমের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন বিসিবি সভাপতি।
এই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
সেখান থেকেই বিসিবি সভাপতির কাছে ফোন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন টাইগার কোচ এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
কোচের এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বিসিবি সভাপতিও।
দেশের ক্রিকেটের দুই প্রধান অভিভাবক তার ওপর অসন্তুষ্ট এবং সে অসন্তুষ্টির কথা পত্রিকার পাতায়ও চলে আসে।
এ কারণে তামিম হয়তো ধরে নিয়েছেন, বিসিবিপ্রধান আর হেড কোচ দুজনই তার ওপর অসন্তুষ্ট।
যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পথে এটা এক বড় বাধা।
এমন ভেবেই ওয়ানডের সঙ্গে টেস্ট থেকেও সরে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছেন তামিম ইকবাল, এমনটি মনে করেন ক্রিকেটবোদ্ধারা।
তামিমের প্রথম ম্যাচ খেলা নিয়ে হাথুরুসিংহে বিসিবি সভাপতির কাছে ফোন করে রাজ্যের
ক্ষোভ প্রকাশ না করলে হয়তো পরিস্থিতি এমনটা হতো না।
বিসিবিপ্রধান নিজেও যদি মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করতেন,
তাহলে তামিম হয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত নিতেন না।
তাই বলা যায় তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অবসরের ঘোষণাই আসে পাপনের কাছে হাথুরুর ফোনের পরপরই।
এর আগে প্রথমবার বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসার পর একপর্যায়ে মাশরাফির ওপর অসন্তুষ্ট হন হাথুরুসিংহে।
মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেন তিনি।
একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মাশরাফি ২০১৭ সালের এপ্রিলে টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেন।
সেই সময়ই ইতি ঘটে মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের।
মাশরাফির পর গতকাল হাথুরুর দ্বিতীয় শিকার হন ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার তামিম ইকবাল।
বুধবার রাতেই ধারণা করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিতে পারেন তামিম।
তবে তার অবসরের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি অনেক ভক্ত, অনুরাগী ও সতীর্থরা।
গতকাল চট্টগ্রামের এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এসে অবসরের ঘোষণা দিয়ে একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বাঁহাতি এই অভিজ্ঞ ব্যাটার।
বক্তব্যের শুরুতে তামিম বলেন, ‘গত বুধবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিই আমার শেষ আন্তর্জাতিক খেলা। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এই মুহূর্তে অবসরের ঘোষণা দিলাম। এই সিদ্ধান্তটি আমি হুট করে নেইনি। আমি গত কয়েক দিন থেকে এটা ভাবছিলাম। আমি পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছি। আমি মনে করি এটাই সঠিক সময় সিদ্ধান্ত নেয়ার।’
তার বাবা ইকবাল খানের স্বপ্ন পূরণ করতেই জাতীয় দলে পা রেখেছিলেন তামিম।
ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় ছোট চাচা প্রয়াত আকবর খানের কাছেই।
তার চাচা আকরাম খান ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক।
ক্রিকেটে তার সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তামিম বলেন, ‘আমি সবসময় একটা কথা বলেছি যে, আমি ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য।
আমি নিশ্চিত নই, এই ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তাকে গর্বিত করতে পেরেছি কিনা।
আরো অনেক মানুষকে ধন্যবাদ জানানোর আছে।
তামিমের অবসর প্রসঙ্গে ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, সিরিজের মাঝখানে হঠাৎ করে অবসর নেয়া দুঃখজনক।
ক্ষোভ ও হতাশা থেকেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
যা তার মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলেছে। চারপাশে হয়তো অনেক চাপ ছিল।
সেই চাপ নিয়ে স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছিল না। যা তামিমের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে।
এ সমস্ত চাপের কারণে সে ভেবে চিন্তে সম্মানজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তামিমের অবসরে দলে প্রভাব পড়বে কিনা- এ প্রসঙ্গে নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, আমাদের দল খারাপ না।
খেলোয়াড়রা জেতার জন্য খেলবে। সবাই শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করবে।
তবে আগে যে আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল তা হয়তো কম থাকবে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে ২০২২ সালের ১৬ জুলাই সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে টি-টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তামিম।
তার এমন অবসরের পর নিজেদের সাইটে তামিমকে নিয়ে একটি ফিচার প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)।
সেই ফিচারে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানায়, ‘ভারত বিশ্বকাপের আগে তামিমের অবসর বাংলাদেশের জন্য বড় ধাক্কা।
টুর্নামেন্টের তিন মাস আগে ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন তামিম।’
তামিমের এমন সিদ্ধান্তে হতবাক বিসিবির কর্মকর্তারা। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেন, ‘আমরা লাইভে তামিমের সিদ্ধান্ত শুনেছি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তার অবসরের সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত।
শকিং নিউজ। খুবই প্রি-ম্যাচিউর সিদ্ধান্ত। হেসে খেলে দুই বছর খেলতে পারত।
বোর্ড থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে।’
জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় রাজিন সালেহ বলেন, ‘তামিমের অবসরের সিদ্ধান্ত দুঃখজনক।
একজন ক্রিকেটারের ফর্ম ওঠা-নামা করতেই পারে।
তামিম দীর্ঘদিন জাতীয় দলে সার্ভিস দিয়েছে।
তার হঠাৎ অবসরের ঘোষণা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড় ধাক্কা।
সামনে বিশ্বকাপ, ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে তার খেলা উচিত ছিল।
সে আমাদের ওয়ানডে অধিনায়ক।
আশা করছি বোর্ড মিটিংয়ে তামিমকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেবে ক্রিকেট বোর্ড।’
জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার তুষার ইমরান বলেন, কোচের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে দল থেকে সরে গিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তামিম।
অনেক দিন ধরে নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট করতে পারছিলেন না তামিম।
ইচ্ছে করলে বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলতে পারত সে। দলে অনেক ব্যাকআপ খেলোয়াড় আছে কিন্তু তার মতো দক্ষ ক্রিকেটারের অভাব রয়েছে।’
দেশসেরা এই ওপেনারের বিদায়ে আবেগঘন বার্তা দিয়েছে জাতীয় দলের সতীর্থরা।
এমনকি সাবেক ক্রিকেটাররাও দিয়েছেন আবেগঘন বার্তা।
নিজের ভেরিফায়েড পেজে টাইগার পেসার তাসকিন লিখেন, মাঠ আর মাঠের বাইরে
আপনার সঙ্গে লম্বা একটা পথচলায় আমাদের অজস্র স্মৃতি ছিল।
একজন ভাই এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে আপনি যতখানি সহযোগিতা করেছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
শেষে তাসকিন জানিয়েছেন, তামিম ইকবালকে মিস করার কথা।
টাইগার অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজও আক্ষেপ করেন।
তিনি লিখেন, ‘১৫ হাজার আন্তর্জাতিক রান নিয়ে আপনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি।
আমি ক্রিকেট এবং জীবন সম্পর্কে তামিম ভাইয়ের কাছ থেকে অমূল্য সব শিক্ষাগ্রহণ করেছি।
আপনার অবিচল সমর্থন, আমার প্রতি রাখা বিশ্বাস এবং সর্বদা সাহস জোগানোর জন্য আপনার প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ।
ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন একজন গ্রেট স্পোর্টসম্যান আপনি।
খেলোয়াড়রা, ভক্ত-সমর্থকরা এমনকি ক্রিকেটও আপনাকে মিস করবে, তামিম ভাই।’